
মুফতী মুক্তাদির হোসাইন মারুফ
যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মতৎপরতার মাধ্যমে উন্নত দেশ গঠন এবং দেশের উন্নতি-অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম। এটা সর্বজন বিধিত যে, কেবল তরুণরাই পারবে সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধশালী আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করতে।
ইসলামে তারুণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তারুণ্য মানবজীবনের অমূল্য এক সম্পদ। এটা জীবন মহীরুহের বিকশিত চারাগাছ। তারুণ্য কাঁচা বয়সের একটি উদ্দীপনার নাম। তারুণ্য অর্থ হচ্ছে বাঁধা না মানা। তীব্র স্রোতের উজান সাঁতারে পাড়ি দেয়াই তারুণ্যের নেশা। চেতানাদৃপ্ত তরুণরা যখন জেগে ওঠে তখন সকল প্রতিবন্ধকতার সকল চড়াই-উৎরাই মাড়িয়ে তারা বিজয় ছিনিয়ে আনে। বিজয়ের পুষ্পমালা তাদের পদচুম্বন করে। ইতিবাচক অর্জনসহ সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের অবদান। তারুণ্য তথা যৌবনকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ইহকালে কল্যাণ ও পরকালীন জীবনে মুক্তির বিশাল বাগিচায় উপনীত হওয়া যাবে।
মানবজীবন মানুষের মহামূল্যবান এক সম্পদ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে তারুণ্য তথা যৌবন। এ কারণে হাদিস শরীফের মধ্যে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন-কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে সেইসব তরুণদের স্থান দিবেন, যারা তরুণ বয়সের সময়কে আল্লাহর রাহে ব্যয় করে কাটিয়েছে (তিরমিজি)।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে যুবক বয়সের ইবাদতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হবে। একজন বৃদ্ধের ইবাদতের চেয়ে আল্লাহ বেশি খুশি হন যে সমস্ত যুবকরা যৌবন বয়সে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে (ইবনে মাজাহ)।
রাসুল (সা.) আরও এরশাদ করেন- হাশরের ময়দানে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ের হিসাব দিতে হবে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে সে তার যৌবনকাল কিভাবে ব্যয় করছে (মিশকাত)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যৌবনকালকে গণিমতের মাল তথা মূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে তা মূল্যায়ন করার তাগিদ দিয়েছেন। কেননা এসময় সম্পর্কে পরকালে জবাবদিহিতা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, আমর ইবনু মায়মুন আল আওদি (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশস্বরূপ বলেন, ৫টি বস্তুর পূর্বে ৫টি বস্তুকে গণিমত মনে করো। যথা- ১. তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে। ২. পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে। ৩. দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে। ৪. ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং ৫. মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে’ (তিরমিজি)।
যৌবনকাল অত্যন্ত মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলনে বিজয়ের সাফ্যলের পেছনে রয়েছে যুব সমাজের অত্মত্যাগ। এই যুবকদের রক্তের বিনিময়ে ভেঙে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়েছে অসংখ্য সরকার বাহাদুরের রাজ্য সীমা। ইতিহাসে চিরঅম্লান হয়ে আছে যুবকদের আত্মত্যাগের স্মৃতি।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্বমানবতার কল্যাণে যুবকদের নিয়েই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংগঠন ‘হিলফুল ফুযুল যুব সংঘ’ গঠন করেছিলেন। হজরত মোহাম্মাদ (সা.) যখন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নেমেছেন তখন সর্বাগ্রে যুবকরাই এগিয়ে এসেছেন। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.) যৌবনকালেই ইসলাম কবুল করেন। আসহাবে কাহাফে যারা ছিলেন তারাও ছিলেন যুবক।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, হে নবী! আপনার কাছে আমি তাদের আসহাফে কাহাফ’র ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি, তাঁরা ছিল কয়েকজন যুবক। তাঁরা তাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিল এবং আমি তাদেরকে সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করে দিয়েছি (সূরা কাহাফ : ১৩)।
ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল (রা.) ছিলেন যুবক। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পাষন্ড নমরুদের তৈরিকৃত আগুনে নিক্ষিপ্তি হয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন যুবক। হজরত ইউসুফ (আ.) যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনি যুবক। হজরত ইউনুস-কে (আ.) যখন সমুদ্রের মাছ গিলে ফেলে তখন তিনি ছিলেন যুবক। হজরত দাউদ (আ.) যখন জালিম শাসক জালুতকে হত্যা করেন তখন তিনিও ছিলেন যুবক।
যুুদ্ধের ময়দানে যুবকরা : যুদ্ধের ময়দানেও যুবকরা ছিলেন দূর্বার। বদরের যুদ্ধে হজরত মাআজ ও মুআজ (রা.) নামক দু’জন কিশোর সাহাবি ইসলামের ঘোর দুশমন আবু জাহিলকে হত্যা করেন। খায়বার বিজয়ী বীর সেনানী শেরে খোদা হজত আলী (রা.) যিনি কামূছ দুর্গের লৌহ কপাট উপড়িয়ে ফেলে এক মুষ্টিতে নিয়ে এটাকে যুদ্ধের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন তখন তিনিও ছিলেন তাগড়া যুবক। মুতার যুদ্ধের সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ তিনিও ছিলেন যুবক। স্পেন বিজয়ী সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ তিনিও ছিলেন যুবক। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধের সেনাপতি হজরত আবু বকর (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.), হজরত জাফর (রা.), হজরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) হজরত তাইয়ার (রা.), হজরত যুবায়ের (রা.), হজরত তালহা (রা.), হজরত অব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদসহ (রা.) প্রায় সাহবায়ে কেরামগণ ছিলেন যুবক।
ভারত বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসেম যখন ভারতে ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনিও ছিলেন যুবক। কুতাইবা বিন মুসলিম যিনি এশিয়ার মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটান তখন তিনিও ছিলেন যুবক। বাংলাদেশেও অনেক আলেম-উলামা, ওলী-আওলিয়াগণ ইসলামের প্রচার-প্রসার করেন তাদের প্রায়ই ছিলেন যুবক।
১৯২৯ সালে যখন ভারতের কুখ্যাত কাফির ‘রাজপাল ‘রঙ্গিলা রাসূল’ নামে একটি বই প্রকাশ করে এবং এ বইটিতে মহানবী (সা.)-এর চরিত্র হনন এবং রাসুল (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করে তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আলিম উদ্দিন নামে এক ভাই শহীদ হন তিনিও ছিলেন যুবক।
আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকটি সংগ্রাম হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষার সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ১৯৯২ এর বাবরী মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, ১৯৯৪-এর নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন, ২০০১-এর ফাতওয়া বিরোধী আন্দোলন, ২০১১-এর কুরআন বিরোধী রায় বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন, ২০১৩ সালে নব্য নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনেই যুবকরাই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন। সবগুলোর পেছনে রয়েছে তরুণদের বলিষ্ঠ ভূমিকা।
এখনও তরুণরাই ইসলাম, নবী, দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের যুবকদের পদচারণায় আজও মুখরিত। বিশ্বজুড়ে চলছে আজ যুবক বা তারণ্যের জয়-জয়কার। জাতির প্রাণের স্পন্দন যুব সমাজ যে উদ্দেশ্যেই জেগেছে সে উদ্দেশ্যই অর্জন করেছে। এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে যুবকদের আত্মত্যাগের কথা। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তরুণদেরই জেগে উঠতে হবে, জাগাতে হবে জাতিকে। মায়ের আঁচলে লুকিয়ে নয়, বোনের স্নেহের ডোরে বাঁধা পড়ে নয়, বাবার শক্ত চাহনিতে ঘরের আড়ালে লুকিয়ে নয়। ইসলাম-মানবতা এবং জাতির কল্যাণে যুবকদের ভূমিকা অপরিসীম।
লেখক: তরুণ মুফাচ্ছিরে কুরআন, পাবনা