
মুফতি আবদুর রহমান গিলমান
বছর ঘুরে আবার এলো পবিত্র ঈদুল আজহা। সারা বিশ্বের মুসলমানের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। কুরবানি আরবি কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত। যার অর্থ নৈকট্য অর্জন করা। পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এই মহা সুযোগকে কাজে লাগায় বিশ্বের সকল মুসলমান।
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আ. আল্লাহ তা’আলার প্রতি যে ভক্তি ও ত্যাগের নিদর্শন স্থাপন করেছেন, সেই আদর্শ বাস্তবায়নে প্রতি বছরই বিশ্বের সকল মুসলমান অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদযাপন করে এই ঈদুল আজহা।
শরিয়া কর্তৃক নির্ধারিত পশু কুরবানির মাধ্যমেই এই বিধান পালন করা হয়। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী কুরবানির নিয়ম-কানুন নির্ধারিত থাকলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির কারণে কুরবানির ঈদ উদযাপনের পদ্ধতিতে রয়েছে ভিন্নতা। বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম দেশ এমনকি অনেক অমুসলিম দেশেও যে সকল মুসলমানরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সাধ্যমত সবাই চেষ্টা করে এই ঈদ উদযাপনের। বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম ও অমুসলিম দেশের কুরবানি পালনের বিচিত্র পদ্ধতি নিয়েই আমাদের এই আয়োজন ।
মুসলিম দেশে কুরবানি
তুরস্ক
ঈদুল আজহার সময়ে তুরস্কে সরকারিভাবে চার থেকে পাঁচ দিনের ছুটি দেওয়া হয়। ঈদের দিন তুরস্কে সরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও পরদিন জাদুঘর, বিনোদন পার্ক ও বিশেষ করে রেস্টুরেন্টগুলো খোলা থাকে। কুরবানি ঈদে তুরস্কের লোকজন পশু জবাই করার পর উদ্বৃত্ত গোশত দাতব্য সংস্থাগুলোকে দান করে দেয়। এছাড়া অনেকে পশু জবাই না করে কুরবানির পশুর টাকা দাতব্য সংস্থাগুলোতে দিয়ে দেয় বাংলাদেশের মতো তুরস্কেও ঈদের আগে ও পরের দিন ট্রেন, বাস ও বিমানে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। তবে ঈদের পর দিন থেকে স্থানীয়রা ঘুরতে বেশি পছন্দ করে।
বাহরাইন
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাহরাইনে এই ঈদে সরকারিভাবে তিনদিনের ছুটি দেওয়া হয়। পশু জবাই ছাড়াও বাহরাইনের স্থানীয়রা একটা রীতি পালন করে। এতে ঈদের সময় বাহরাইনের এক ধরনের বিশেষ গাছকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া নতুন পোশাক, ঈদের নামাজ ও গোশত বিতরণ অন্যান্য দেশের মতো বাহরাইনবাসীও পালন করেন।
পাকিস্তান
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানে ঈদুল আজহা পালিত হয় চার দিন ধরে। উট ও দুম্বা এ দেশে কুরবানির জন্য প্রাধান্য পায়। এই দিনে দেশটিতে সব ধরনের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ থাকে। সকালে ঈদগাহে ঈদের নামাজ ও খুতবার পর আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যে পশু কুরবানির পর তার গোশত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করা হয়। বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানের সরকারও ঈদুল আজহায় তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে থাকে। পাকিস্তানে ঈদের দিন নতুন পোশাক, বিশাল জামায়াতের মাধ্যমে ঈদের নামাজ আদায় করা, পরিবারের সদস্যের সঙ্গে দেখা করা। ঈদ উপলক্ষে সরকারি অফিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে । আর বাংলাদেশের মতো পাবলিক পরিবহনেও প্রচণ্ড ভিড় থাকে।
সৌদি আরব
সৌদি আরব হচ্ছে ইসলামিক ঐতিহ্য, প্রথা ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। ঈদুল আজহার সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই হজ পালন করতে সৌদি আরবে আসে। তাই সৌদি আরবের লোকজন ছাড়াও অন্যান্য দেশের মানুষ ঈদে ছাগল বা দুম্বা জবাই করে ঈদ পালন করে। আর সৌদি আরবে ঈদে অতিথিদের এক কাপ কফির সঙ্গে খেজুর ও মিষ্টি জাতীয় খাবার দেওয়ার রীতি আছে। এছাড়া ঈদে সৌদি আরবের লোকজন ব্যয়বহুল কাপড় ছাড়াও আমাদের দেশের মতো বিশাল জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে।
ফিলিস্তিন
অনেকের জানার আগ্রহ হয় গাজায় ঈদুল আজহার সময় কিভাবে ঈদ পালন হয়? বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গাজায় পশু জবাইয়ের মাধ্যমে ঈদ পালন করা হয়। সম্প্রতি ইসরাইলি হামলা বেড়ে যাওয়া ঈদের উৎসবেও গাজার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকার পরও ফিলিস্তিনিরা পশু জবাই করে ঈদ পালন করে। যদিও এখানে খুব কম সংখ্যক স্থানীয়রা পশু জবাই করে । গাজায় অধিকাংশ কুরবানির পশু আসে পাশের দেশ মিসর থেকে টানেলের মাধ্যমে। কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধের সময়ে এই টানেল ভেঙে যাওয়ায় দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও পশু জবাই করে ঈদ উদযাপনের রীতি কিছুটা ভেঙে পড়েছে গত কয়েক বছর ধরে গাজায় কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ঈদের সময় পশু জবাই করে গাজায় গরীবদের মাঝে গোশত বিতরণ করে। এক সরকারি তথ্য মতে, গাজায় ২০১৩ সালে ৩৪ হাজার গরু, ভেড়া ও উট পাশের দেশ মিসর থেকে টানেলের মাধ্যমে আনা হয়। তবে গাজায় প্রতিবছর প্রায় ৫২ হাজার পশুর প্রয়োজন হয়।
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটি থাকে। এই দিনে ইন্দোনেশীয় মুসলমানরা সকালে ঈদের নামাজ ও খুতবার মধ্য দিয়ে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। তারপর গবাদি পশু, যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি কুরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহার মূল আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। তারা কুরবানির গোশত আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করেন। এই দিনে নতুন পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো এবং শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপহার বিলি করার প্রচলনও রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়।
মিসর
মিসরে ঈদুল আজহা মূলত ‘ঈদুল কিবর’ হিসেবে বেশি পরিচিত। এখানে সকালে মসজিদগুলোতে একত্রে নামাজ পড়া ও খুতবা শোনা এবং তারপর পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঈদের আনুষ্ঠানিকতা। ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতার পরেই সবাই আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন এবং একসাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন। এই দিনে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা দরিদ্রদের মাঝে গরুর গোশত এবং অন্যান্য খাদ্য বিতরণ করে। এদিন সারা দেশে সরকারি ছুটি থাকে।
আফগানিস্তান
আফগানবাসী এদিন কুরবানি দিয়ে আত্মীয় এবং গরিবদের মাঝে গোশত বিতরণ করেন। এদিন বিচ্ছিন্ন কিংবা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়া বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনরা সব বিভেদ ভুলে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন। ঈদ উপলক্ষে আফগানিস্তানে পোশাক, জুতা, ফল, ফার্নিচার ইত্যাদির বাজার জমে ওঠে। ঈদে আফগানরা অবশ্যই তাদের পরিবারের জন্য কিছু কিনতে চেষ্টা করেন। ছোটরা এদিন উপহার পায়। তবে আফগানিস্তানের গরিব মানুষ ঈদে কুরবানি দেওয়া বা ঈদ উদযাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
মালদ্বীপ
ঈদুল আজহা মালদ্বীপের অন্যতম উৎসব। দিনটি সেখানে ঈদ-এ কোরবান বা কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। মালদ্বীপে প্রধানত ভেড়া, ছাগল কুরবানি দেওয়া হয়। এছাড়া আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো আর দানের মাধ্যমে মালদ্বীপবাসী ঈদ উদযাপন করে। ঈদ উপলক্ষে এরা তাদের ঘরবাড়ি সুন্দর করে সাজায়, অনেকে সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ছুটি কাটাতে যায়।
দুবাই
দুবাইয়ে ঈদুল আজহা পালিত হয় চারদিন ধরে। মুসলিম অধ্যুষিত শহর এবং গ্রামগুলো বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়। শিশুরা নতুন পোশাক পরে এবং বড়দের কাছ থেকে ঈদের সালামি ‘ঈদিয়া’ পায়। ওইদিন অতিথিদের দুবাইয়ের স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি এবং ফল দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কুরবানি দেন। ঈদ উপলক্ষে দুবাই ইভেন্টস অ্যান্ড প্রমোশন এস্টাবলিশমেন্ট শহরে উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এর মধ্যে আছে কনসার্ট, কমেডি শো ইত্যাদি। এদিন দুবাই এয়ারপোর্টে যাতায়াতকারী অতিথিদেরও ঐতিহ্যবাহী কফি এবং মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
অমুসলিম দেশে মুসলিমদের কুরবানি
যুক্তরাজ্য
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে যুক্তরাজ্যে মুসলমান আছেন সাড়ে ২৭ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার ৪.৮ ভাগ । অধিকাংশ মুসলমানই ইংল্যান্ডে ও ওয়ালেসে বসবাস করেন। যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা ততটা ধর্মভীরু নন। যারা কেবল মসজিদ ও তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাই দৃঢ়ভাবে ইসলাম পালন করে থাকেন দুই ঈদে। মুসলমানরা ট্রাফালগার স্কয়ারে মিলিত হন এবং ঈদ উদযাপন করেন। তবে সেখানকার ঈদ বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো তেমন আড়ম্বরপূর্ণ হয় না। যুক্তরাজ্যে প্রকাশ্য পশু জবাই করা নিষিদ্ধ হলেও নির্ধারিত এলাকায় সরকার নিয়ন্ত্রিত। প্রতিষ্ঠান থেকে কুরবানি দেওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে অনেক এশিয়ান বা বাংলাদেশি গ্রোসারি ঈদের সময় কুরবানির জন্য আগ্রহীদের নাম সংগ্রহ করে থাকে। ঈদের প্রায় এক মাস আগে থেকে দোকানে দোকানে সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকে: এখানে কুরবানির অর্ডার নেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে এখানে নাম লিখিয়ে প্রতি নামের বিপরীতে অর্থ দিয়ে যেতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কুরবানির পর গরু বা ভেড়ার গোশত ঈদের পরের দিন গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে তারা।
অস্ট্রেলিয়া
ঈদুল আজহার দিন অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি ছুটি থাকে না। তবে ইসলামিক স্কুল, সামাজিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দিনটিতে বন্ধ থাকে। অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস প্রধানত সাবারবান শহরকে কেন্দ্র করে। এখানে আলাদা কুরবানির পশু কিনে লালন-পালন করার সুযোগ না থাকায় কয়েকটি পরিবার মিলে একজনকে পশু কেনার এবং যত্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে তারা কুরবানি করেন। মুসলমানরা কুরবানির গোশত এবং চামড়ার টাকা গরিবদের দান করেন। মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও কুরবানির গোশত উপহার হিসেবে দান করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানরা এদিন ‘বাকলাঙা’ এবং ‘লোকুম’ নামের দুটি তার্কিশ ডিম রান্না করে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করেন দক্ষিণ আফ্রিকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। প্রতি বছরই দেশটির রাজধানীতে ঈদের জামাতগুলোতে চোখে পড়ে লাখো মুসল্লিদের ঢল। নামাজ শেষে তারা নির্দিষ্ট স্থানে পশু কুরবানি করেন। ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিক ভেদাভেদ ভুলে সবাই মশগুল হন একে অপরকে দাওয়াত দিতে ও দাওয়াত নিতে। দিন শেষে বাঙ্গালীসহ অধিকাংশ প্রবাসীই দেশে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের কুশল এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন ফোন, ফেসবুক ও টুইটারসহ সামাজিক বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে।
ফিনল্যান্ড
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ফিনল্যান্ডজুড়ে মুসলমানরা উদযাপন করেন বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। নতুন পোশাক পরে কনকনে শীতের মাঝেও ফিনল্যান্ডের স্থানীয় মুসলমানসহ প্রবাসী বাংলাদেশীরা সমবেত হন ঈদের জামাতে। রাজধানী হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের জামাত। ঈদ উৎসবে সেখানে দেশি-বিদেশি রকমারি খাবার, একে অপরের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া, প্রবাসীরা স্বদেশে মুঠো ফোনে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়সহ নানা আয়োজনে মশগুল থাকেন।
সুইডেন
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সুইডেনে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মসজিদের উদ্যোগে ওসা জিমনেশিয়ামে বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী সেখানেও নামাজের আগে কুরবানির তাৎপর্যের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয় । সালাতুল ঈদ শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর সুখ ও সমৃদ্ধি কামনায় করা হয় দীর্ঘ মোনাজাত।
নিউইয়র্ক
নিউইয়র্কে সবচেয়ে বৃহত্তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় সেখানকার অন্যতম বাংলাদেশী প্রধান এলাকা জ্যামাইকায়। শহরের ম্যানহাটন, জ্যাকসন হাইটস, উডসাইড ও ব্রুকলিন এলাকায় বাংলাদেশীদের পরিচালিত জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ জামাতটি। প্রতি বছরই এতে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। ঈদের জামাতে অংশগ্রণকারী মুসল্লিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় জেএমসিতে তিনটি জামাতের ব্যবস্থা করার পরও বহু মুসল্লি জামাতে অংশ নিতে না পারায় জেএমসি দু’বছর ধরে ১০টি খোলা মাঠে নামাজের ব্যবস্থা করছে। এছাড়াও মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড়ে কোনো কোনো মসজিদে পাঁচটি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
চীন
পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার শতকরা ১২ জন মুসলমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ এই চীনে। এ হিসেবে ১৩৬ কোটি মানুষের দেশ চীনে আছেন সাড়ে ১৬ কোটি মুসলমান। হুই, উইঘুর, কাজাক, উজবেক, তাজিক, তাতার, খালখাস, সালার, ডংঝিয়াং ও বাওয়ান, ইত্যাদি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে বিভক্ত তারা বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন। হুই, উইঘুর, কাজাক ও সালার জনগোষ্ঠী চন্দ্র বছরের পঞ্জিকা দেখে ঈদ উদযাপন করেন। নিংঝিয়া প্রদেশের হুই মুসলমানরা ঈদুল ফিতরকে বড় ঈদ মনে করে থাকেন এবং গানসু ও চিংহাইয়ের হুই মুসলিমরা এটিকে মনে করেন বছরের শুরু। আবার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। চীনের মুসলমানরা যেখানেই কাজ করেনা কেন দুটি ঈদেই তারা বাড়িতে আসেন এবং সবাই একত্রে মিলে ঈদ উদযাপন করেন। তবে গত কয়েক বছর ধরেই চীনের মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম পালনে সরকারিভাবে বেশ ভালই বাধা আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের রোজা রাখা নিষিদ্ধ করেই চীন সরকার থেমে থাকেনি; বরং স্কুল কলেজগুলোতে মুসলিম ছাত্রদেরকে জোর করে রোজা ভাঙানোর অভিযোগও উঠেছে স্থানীয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি চীনে দাড়ি রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
জার্মানি
জার্মানিতে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ৬০ ও ৭০ দশকের পর থেকে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী জার্মানিতে মুসলমান আছেন ৪৩ লাখ (মোট জনসংখ্যার ৫.৪ ভাগ) এবং তাদের মধ্যে জার্মান নাগরিক হলেন ১৯ লাখ (মোট জনসংখ্যার ২.৪ ভাগ)। জার্মানির মুসলমানদের শতকরা ৬৩ ভাগ তুর্কি বংশোদ্ভূত। জার্মান মুসলমানদের জন্য দুঃখজনক ব্যাপার হলো তারা দুই ঈদসহ কোনো ধর্মীয় উৎসবেই সরকারি ছুটি পান না। যেসব মুসলমান সরকারি চাকরিজীবী তাদের খ্রিস্টান সহকর্মীদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি দেয়া হলেও মুসলমানরা তা পান না। এখানে কেবল খ্রিস্টানদেরই ধর্মীয় উৎসবে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। জার্মানিস সেন্টার কাউন্সিল অব মুসলিমের সভাপতি আইমান মাজইয়াক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারের কাছে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবেও ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। জার্মানিতে তাই মুসলমানদের ঈদে ততটা সমারোহ হয় না। অধিকাংশ মুসলমান বার্লিনে বা শহরাঞ্চলে থাকেন। তাই তারা এখানেই ঈদের নামাজ আদায় করেন।
ভারত
বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মুসলমানদের মোট সংখ্যা অনেক বেশি হলেও তা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪.৬ শতাংশ। তাই ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশটিতে এক দিনের সরকারি ছুটি পালিত হয়। সারা পৃথিবীর মতো ভারতে ঈদ উল আজহা উপলক্ষে বিশেষ প্রার্থনা, উপহার ও শুভেচ্ছার মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করা হয়। ভারতে ঈদ উল আজহা ‘ঈদ উল যুহা’ বা ‘বকরি ঈদ’ নামে বেশি পরিচিত। এই দিনে ভারতের প্রচুর মুসলিম নতুন জামা কাপড় ছাড়াও উন্মুক্ত আকাশের নীচে ঈদ উল আজহার নামাজ আদায় করে। ঈদে ভারতের অধিকাংশ মুসলিম রাজ্যে ভেড়া, ছাগল ও গরু দিয়ে উৎসব পালন করে। এই কুরবানির গোশত পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এই চিত্র বেশি দেখা যায়। এই দিনে ভারতের সরকারি অফিস, ডাকঘর, ব্যাংক ইত্যাদি পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধ থাকা বাধ্যতামূলক নয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, কাতার, মিসর, তুরস্ক, ইয়েমেন, সিরিয়া, জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন ইত্যাদি দেশে কুরবানির জন্য পশুর মধ্যে উট ও দুম্বাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। প্রায় সবগুলো দেশে ইসলাম প্রধান ধর্ম হওয়ায় ঈদুল আজহা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। অন্তত তিন দিনের সরকারি ছুটিতে এসব দেশের মানুষ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এই উৎসব পালন করেন।
আফ্রিকার দেশ
মরুভূমি অঞ্চলের দেশ হওয়ায় আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত দেশ যেমন মরক্কো, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, মালি, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, সিয়েরালিওন, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে কুরবানি দেওয়ার জন্য ‘মরুভূমির জাহাজ’ হিসেবে খ্যাত উটই প্রধান প্রাণী। পাশাপাশি গরু, দুম্বা, ছাগল ইত্যাদি কুরবানি করা হয়। এসব দেশে ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে এবং নতুন পোশাক পরে সবাই ঘুরতে বের হয় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাসায়।
পশ্চিমা দেশ
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি পশ্চিমা দেশে ঈদের জন্য পৃথকভাবে কোনো সরকারি ছুটি নেই। তাই ব্যক্তিগতভাবে ছুটির আবেদন করে যারা ছুটি পান, কেবল তারাই কোনোভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, বাকিরা সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতোই কাজে চলে যান। এসব দেশে বসবাসরত মুসলমানরা ঈদুল আজহার দিন সকালের নাশতার আগেই মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়েন এবং তারপর ফিরে এসে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পশু কুরবানির পরে একত্রে সময় কাটান। এসব দেশে বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাস্তাঘাটে পশু জবাই করার নিয়ম নেই। অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কসাইখানায় পছন্দমতো গবাদি একটি বেছে টাকা দিয়ে দেন এবং ঈদের দিন সেখান থেকেই নিয়ম অনুসারে কাটাকুটি শেষ হওয়ার পরে তা ক্রেতাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া এসব দেশে বসবাসরত বাঙালিরা সেখানে জবাই না করে দেশে বসবাসরত আত্মীয় স্বজনের কাছে কুরবানির জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েও আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন।
কুরবানির পশু পরিচিতি
গরু
সাধারণত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে প্রতি বছর প্রচুর গরু এই ঈদে কুরবানি দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে বেশি কুরবানি দেওয়া হয় সম্ভবত বাংলাদেশেই। আর একটি গরু একা যেমন কুরবানি দেওয়া যায়, আবার সাত ভাগ করে সাতজন মিলেও দেওয়া যায়। বাংলাদেশের কুরবানির হাটগুলোতে প্রতি বছর লাখ লাখ গরু আসে। হাটগুলোতে গেলে তাই গরুই চোখে পড়ে বেশি। এসব গরুর দাম ২৫-৪০ হাজার থেকে শুরু করে ৩০-৪০ লাখ টাকাও হয়। তবে কুরবানি দিতে হলে গরুর বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হয় ।
মহিষ
কুরবানির পশু হিসেবে আমাদের দেশে মহিষেরও প্রচলন আছে। সাধারণত গ্রামেই মহিষ কুরবানি দেওয়া হয়। এই মহিষ আসলে গরুরই এক রকমের জাত। তবে গোশত গরুর গোস্তের মতো মজাদার না। তাই গরুর চেয়ে মহিষের দামও কম, কাটতিও কম। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও কুরবানির ঈদে মহিষ কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানির জন্য গরুর মতো মহিষের পূর্ণ দুই বছর হতে হয়।
উট
উটের শুধু পা-ই যে লম্বা তা না। ওদের গলাও পায়ের মতো অনেক লম্বা হয়। পিঠে বড়সড় একটা কুঁজও থাকে। তবে এরা বেশি বিখ্যাত পানি জমিয়ে রাখার ক্ষমতার জন্য। মরুভূমির জাহাজ নামে পরিচিত এই প্রাণীদের গলায় থলির মতো একটা অংশ আছে; সেখানে ওরা পানি জমিয়ে রাখতে পারে। আর সেই জমানো পানি দিয়েই বেশ কয়েক দিন দিব্যি চালিয়ে নিতে পারে। এ কারণেই, মরুভূমিতে চলাচলের জন্য উট-ই সেখানকার মানুষের বড় সহায়। তাই মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে গৃহপালিত পশু হিসেবে উট ভীষণ জনপ্রিয়। খাবার হিসেবেও উটের মাংস বেশ উপাদেয়। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব দেশগুলোতে কুরবানির ঈদে উট-ই বেশি কুরবানি দেওয়া হয়। শুধু সেখানেই না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কুরবানির পশু হিসেবে উট বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও আজকাল কুরবানির ঈদে উট কুরবানি দেওয়া শুরু হয়েছে। সাধারণত ভারতের রাজস্থান থেকে এসব উট আমদানি করা হয়। তবে কুরবানির অন্যান্য পশুর তুলনায় উটের দাম একটু বেশি-ই; একেকটা উটের দাম ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে কুরবানির জন্য উটের বয়স পূর্ণ পাঁচ বছর হতে হবে।
ছাগল
কুরবানির পশু হিসেবে ছাগলেরও চাহিদা ভালো। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুরবানির ঈদে ছাগল কুরবানি দেওয়া হয়। তবে গরুর মতো ছাগল ভাগে কুরবানি দেওয়া যায় না। একটি ছাগল একজনই কুরবানি দিতে পারে। আমাদের দেশে গরুর পরে সবচেয়ে বেশি কুরবানি দেওয়া হয় ছাগল। তাই হাটগুলোতে ছাগলও প্রচুর দেখা যায়। ১ বছর বয়সী যে কোনো ছাগলই কুরবানি দেওয়া যায়। আর এসব ছাগলের দাম ৫-৮ হাজার টাকা থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকাও হয়।
ভেড়া
প্রায় সব দেশেই প্রতি বছর কম-বেশি ভেড়া কুরবানি দেওয়া হয়। তবে গরু ছাগল বা উটের তুলনায় ভেড়া কুরবানি দেওয়ার পরিমাণ অনেক কম। আকারে- আকৃতিতে ভেড়া-ছাগল একই রকমের, সমান-সমান। তবে ভেড়ার বিশেষত্ব এদের ঘন কোঁকড়ানো পশম। এই পশম অনেক কাজেও লাগে। বাংলাদেশে কুরবানির পশু হিসেবে ভেড়ারও অল্পবিস্তর চল আছে। মূলত গ্রামাঞ্চলেই ভেড়া কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানির জন্য ভেড়ার বয়স পূর্ণ এক বছর হতে হবে।
দুম্বা
মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও প্রচুর দুম্বা কুরবানি দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে কুরবানির পশু হিসেবে দুম্বার চল নেই বললেই চলে দুম্বা আকার-আকৃতিতে অনেকটা গরুর মতোই। অবশ্য এদের গায়ে লম্বা লম্বা পশমও থাকে। আর গোশতও খেতে বেশ সুস্বাদু। কুরবানির জন্য দুম্বার বয়স পূর্ণ এক বছর হতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া দুম্বা শারীরিক দিক দিয়ে এক বছরের মতো হলে এর দ্বারাও কুরবানি জায়েজ।