মাওলানা শেখ মুহাম্মাদ ফজলে বারী মাসউদ
সরল অনুবাদ: (লোকমান আ. তার সন্তানদেরকে বললেন) হে আমার পুত্র, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ কর এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্বিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা লোকমান : ১৭-১৮)
ব্যাখ্যা : সন্তান মহান আল্লাহর এক বড় নেয়ামত। সন্তান ছাড়া বৈবাহিক জীবন যে কতটা ধু-ধু-ময় তা কেবল নিঃসন্তান দম্পত্তিই বলতে পারবেন। শিশু সন্তানকে রাসুল সা. 'আল্লাহর খুশব' হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন (তিরমিযি)। আজকের নবজাতক আগামী দিনে দেশ ও জাতির কর্ণধর। তাকে সুন্দরভাবে লালন পালন করতে পারলে জাতির ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল। এজন্য ইসলাম শিশুদের লালন পালনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পবিত্র কুরআনে কমপক্ষে তিনজন নবী ও একজন হাকিম এবং তাদের সন্তানদের আলোচনা করা হয়েছে। রাসুল সা. বলেন, সন্তানকে উত্তম আদর্শবানরূপে গড়ে তোলাই হলো তার প্রতি পিতামাতার সবচেয়ে বড় অনুদান। (তিরমিযি)
নিম্নে সন্তানদেরকে আদর্শরূপে গড়ে তোলার জন্য ইসলামের কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
১. প্রথম কথা কি হবে? রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের সন্তানদেরকে প্রথম কথা শিক্ষা দাও 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' (বায়হাকী)
২. চরিত্র গঠন : তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ভালোবাসা দাও, সর্বোত্তম শিষ্টাচার ও নৈতিকতা শিক্ষা দাও। (ইবনে মাজাহ)
৩. সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা : রাসুল সা. বলেছেন, পিতার ওপর সন্তানের প্রতি দায়িত্ব হলো তার একটি সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)
৪. সন্তানের জন্য দোয়া করা : রাসুল সা. বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া অবশ্যই আল্লাহর নিকট কবুল হয়। এর মধ্যে একজন হলো : সন্তানের জন্য পিতামাতার দোয়া। (তিরমিযি)
৫. সন্তানদেরকে ভালোবাসা : সন্তানকে ভালোবাসা নবীজীর সুন্নাত। একদা রাসুল সা, নাতি হাসান রা. কে কোলে নিয়ে চুমু দিচ্ছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবী আকরা ইবনে হাবিস রা. বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমার দশটি সন্তান। আমি তো তাদেরকে কখনই চুমু দেই না। রাসুল সা. তার দিকে বিস্ময়ভরে তাকালেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হয় না । (বুখারি)
৬. প্রয়োজনীয় শাসন করা : সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শাসনও থাকতে হবে। অনেকে অতিরিক্ত মমতা দেখাতে গিয়ে সন্তানের বৈধ-অবৈধ সব চাহিদা পূরণ করে থাকে। ফলে ননীর পুতুল দিনে দিনে পথের নেড়ী কুকুর এর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। এরাই আজ আমাদের সমাজকে খাবলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. এজন্যই বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের থেকে শাসনের লাঠি তুলে নিও না।
৭. কমপক্ষে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা দেয়া : সন্তান বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কমপক্ষে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা প্রদান করা। ছোট বেলা থেকেই তাকে শরিয়তের বিধানাবলী শিক্ষা দেয়া এবং এগুলো মানতে অভ্যস্ত করা। হাদিসে এসেছে, সাত বছরে পদার্পন করেলেই তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সালাত আদায়ের জন্য আদেশ দাও এবং বিছানা পৃথক করে দাও। দশ বছরে পৌঁছলে সালাত আদায় না করলে দৈহিক শাস্তি দাও। (আবু দাউদ)
একটি চমৎকার ঘটনা : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রা. তখন দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতি। একদা জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁর নিকট নিজ সন্তানের বিরুদ্ধে বিচার দিলেন যে, তার সন্তান তার অবাধ্য। আরজি শোনামাত্র বিশ্বনন্দিত শাসক সন্তানকে ডাকলেন এবং জবাব চাইলেন। সন্তান উল্টো খলিফাকে প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা আমিরুল মুমিনিন! দয়া করে বলবেন কি, সন্তানের কি পিতার ওপর কোন হক আছে? উমর রা. বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। অভিযুক্ত সন্তান বললেন, সেগুলো কি? উমর রা. বললেন, সেগুলো কমপক্ষে তিনটি। ১. উত্তম সন্তানের জন্য সে প্রথমে একজন উত্তম দীনদার নারীকে বিবাহ করবে। ২. সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার একটি সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখবে। ৩. তাকে কুরআন তথা দীন শিক্ষা দিবে।
এবার মুখ খুলল অভিযুক্ত সন্তান। বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! আমার পিতা আমার ব্যাপারে এর কোনটাই করেনি। ১. আমার মা হচ্ছেন ক্রীতদাসী। এক সময় অগ্নিপূজারী ছিলেন। ২. আমার নাম রেখেছে জুলান (অর্থাৎ-গোবরের পোকা ) ৩. আমার বাবা আমাকে ন্যূনতম দীন শিক্ষা দেয় নি ।
উমর রা. তখন অভিযোগকারী পিতাকে বললেন, তুমি এসেছ সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে, অথচ তুমিই তো তার প্রতি আগে অবিচার করেছো। (তারবিয়াতুল আওলাদ ফিল ইসলাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৮)
শিশুকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলতে উল্লেখিত নির্দেশনা ছাড়াও ইসলামে রয়েছে একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা। আমাদের নবপ্রজন্মের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এর অনুস্বরণ করা হতো তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র হয়ে উঠত চমৎকার, এগিয়ে যেত দূর বহু দূরে।
লেখক : মুহতামিম ও মুহাদ্দিস
জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া, ঢাকা।
যোগাযোগ : ৫৫/বি (৩য় তলা), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
ইমেইল : ijadms16@gmail.com
© স্বত্ব ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ প্রচার বিভাগ (২০২৪)