
মাওলানা এম. শামসুদদোহা তালুকদার
মানুষের ভুলভ্রান্তি স্বাভাবিক। ধর্মীয় বিধিনিষেধের ব্যাপারে উদাসীনতায় ভুলের উৎপত্তি। তখন বৈষয়িক বিষয়াদি তার নিকট মুখ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এক পর্যায়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ তার নিকট ফিকে হয়ে যায়; ফলে সে পাপ করতেই থাকে। পাপ বা গুনাহ করতে করতে এর ভাণ্ডারকে স্ফীত করে তোলে। ইবাদতের ক্ষেত্রে গুনাহ করলে আপাত দৃষ্টিতে অন্যের তেমন ক্ষতি হয় না; কিন্তু সে তার প্রতিপালককে বঞ্চিত করে।
মহান আল্লাহই হচ্ছেন আমাদের প্রতিপালক যা একজন মুমিন মুসলিমের ঈমানের মূল ভিত্তি। আল্লাহর নাফরমানি করলে তিনি তা সহ্য করেন না, বান্দার দ্বারা আনুগত্যের পরিবর্তে উপেক্ষিত হলে মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি আর অনুকম্পা করেন না। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁর এমন উম্মতের জিম্মাধার হবেন না । ফলশ্রুতিতে এমন নালায়েক বান্দার পরিণতি হবে জাহান্নাম। অনন্তকাল মহা অনলের বাসিন্দা হবে সে। তবে পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দিয়েছেন বান্দাকে মহান আল্লাহ।
তিনি এরশাদ করেছেন- “আর যারা কখনো কোনো খারাপ কাজ করে ফেলে অথবা তারা তাদের নফসের ওপর কোন অত্যাচার করে ফেলে তখন তাদের সাথে সাথে আল্লাহর কথা স্মরণে পড়ে আর তারা তাঁর নিকট তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ গুনাহসমূহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনে শুনে গুনাহের ওপর হঠকারিতা করে।” -সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৫।
অনুতপ্ত হয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ে যদি বান্দা আর কখনো পাপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন মহান আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে তার তওবা কবুল করে নেন বান্দাকেও নিরাশ হওয়া চলবে না- যত বড় গুনাহই হোক না কেন, তওবার দ্বারা বান্দা নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে নিতে পারে।
তওবা কবুলের ক্ষেত্রে বান্দাকে মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাবান থাকতে হবে। প্রকৃত মুমিনের বিশেষ গুণ হলো- তারা অত্যাধিক তওবাকারী, আর কোন অবস্থাতেই আল্লাহ থেকে নিরাশ হয় না। আল্লাহর ভয়ে বান্দাকে পাপের অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হবে- সদা সর্বদা তওবার মাধ্যমে বিনম্র ক্ষমা চাইতে হবে মাওলার নিকট, প্রতিপালক হিসেবে তখন মহান আল্লাহ বান্দার দিকে ফিরে তাকান, বান্দাকে মাফ করেন আর জাহান্নাম থেকে অবমুক্ত করে দেন।
মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেছেন- “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদেরকে শয়তানের কোন দল এসে স্পর্শ করলেও তারা সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তারা পরিষ্কার দেখতে পায় যে, সঠিক পথ কী”। -সুরায়ে, আরাফ, আয়াত- ২০১।
প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ মানুষের মাঝেই দোষত্রুটি বিদ্যমান। আল্লাহর দেয়া বিধানমতো মানুষ তার জীবন প্রবাহ পরিচালিত করে না। অহরহ গুনাহ করতেই থাকে। গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার প্রচেষ্টা চালালেও গুনাহমুক্ত জীবন পরিচালনা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ গুনাহ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না। এজন্যেই সদা সর্বদা গুনাহ মাফের জন্য বান্দাকে তওবার মাঝে থাকতে হবে। পুনঃপুনঃ তওবার মাধ্যমে মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। আত্মার মাঝে স্নিগ্ধতা আসে, নেক আমল করতে আত্মা উৎসাহ দেয়। শয়তানের কু-মন্ত্রণা তখন অকেজো হয়। মানুষ নিজেকে গুনাহগার মনে করে অধিক পরিমাণে তওবা করবে আর আল্লাহর রহমত কামনা করবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “সকল মানুষই গুনাহগার উত্তম গুনাহগার হল ঐ ব্যক্তি যে অধিক তওবাকারী।” -তিরমিযী।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ অসংখ্য স্থানে বান্দাকে তওবা করার ব্যাপারে উৎসাহ ও নির্দেশ দিয়েছেন। বান্দার কিসে মুক্তি লাভ হবে সে ব্যাপারেও তিনি বলেছেন। বান্দা যদি শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করে তওবা ও ইস্তেগফার করে। বান্দার অন্তরে বিশ্বাস থাকা চাই- আল্লাহ তাদের গুনাহের ওপর ক্ষমা ও মাফের হাত সম্প্রসারিত করে দেবেন, কেননা তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও আপন বান্দাদেরকে অত্যাধিক ভালবাসেন।
মহান আল্লাহর ইরশাদ হচ্ছে- “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর আর তার নিকট তওবা কর, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক অত্যন্ত দয়ালু ও বান্দাদের অধিক মহব্বতকারী।” -সুরায়ে হুদ, আয়াত-৯।
জীবনে যে কোন গুনাহের ওপর লজ্জা ও শরমের অনুভূতি সৃষ্টি হলে তাকে আল্লাহর মেহেরবানি মনে করে বুঝতে হবে তওবার দরজা এখনো খোলা আছে। আল্লাহ তা’আলা তার বান্দার তওবা মৃত্যু পর্যন্ত কবুল করেন, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হবার পর যখন সে অন্য জগতের দিকে উঁকি দিতে থাকে তখন তওবার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।
মানুষ কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় যখন প্রহর গুনে তখন তাকে দু’আ-দুরুদ পড়ানোর রেওয়াজ আছে এ সমাজে, হাফেজ তালেবে এলেমদেরকে ডেকে কুরআন খানি করানো হয়, দু’আ- মাহফিলের আয়োজন করা হয়- এছাড়া তখন বিকল্প উপায়ও থাকে না। মৃত্যু পথযাত্রী বান্দা যেন মৃত্যুর পরে নিরাপদে থাকেন, কবরে যেন শান্তিতে থাকেন এ আশায়ই তারা এমন করে থাকেন।
কিন্তু এসবে সে কতটুকু উপকৃত হয় সে বিতর্কে না গিয়ে সহজেই বলা যায়- বান্দার নিজের পরিত্রাণের ক্ষেত্রে নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হয়। সারা জীবন গাফেল থেকে মরণের সময় দু’আ দুরুদে ভরসা করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। উপরন্তু কে-ই বা নিশ্চিত বলতে পারে- মরণের সময় তওবা-ইস্তেগফার করার সময় সে পাবে।
সুতরাং জীবনের প্রতি মুহূর্তকেই কাজে লাগাতে হবে। তওবা ইস্তেগফার করে বান্দাকে পঙ্কিলমুক্ত থাকতে হবে। গুনাহে আর জড়াবে না, নেক আমলে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত বারবার তওবা করার সুযোগ নিতে হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “আল্লাহ তা’আলা নিজের বান্দার তওবা কবুল করেন নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।” -তিরমিজি।
হজরত ইউসুফ আ.-এর ভাইগণ তাঁকে অন্ধ কূপে ফেলে দিলে তাদের ধারণা ইউসুফ আ.কে শেষ করে দিয়েছে। আর তার জামা রক্তে রঞ্জিত করে তাদের পিতাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছে যে, ইউসুফ আ. মারা গেছে, তাকে বাঘে খেয়েছে।
কিন্তু এ মহাপাপ করার পর কয়েক বৎসরে তাদের মধ্যে যখন নিজেদের পাপের অনুভূতি জাগল এবং তারা লজ্জিত হয়ে যখন তাদের পিতার নিকট আরজ করল যে, আব্বাজান! আল্লাহর নিকট দু’আ করুন। আল্লাহ যেন আমাদের গুনাহ মাফ করে দেন।
তখন আল্লাহর নবী ইয়াকুব আ. এ কথা বলে তাদেরকে নিরাশ করে দেননি যে, তোমাদের গুনাহ বিরাট, এ গুনাহের ওপর কয়েক বৎসর অতীত হয়ে গিয়েছে এখন আবার ক্ষমার কি প্রশ্ন? বরং তিনি তাদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, আমি অবশ্যই আমার প্রতিপালকের নিকট তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব, আর তাদেরকে এ আশ্বাস দিয়েছেন যে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। কেননা তিনি মহান ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু।
ইরশাদ হয়েছে যে, “তারা বলল, হে আমাদের আব্বাজান! আমাদের গুনাহ মাফের জন্য দু’আ করুন সত্যি আমরা বড় পাপী। তিনি বললেন- আমি আমার প্রতিপালকের নিকট নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য গুনাহ মাফের দু’আ করব! নিশ্চিত তিনি মহান ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু।” -সুরায়ে ইউসুফ, আয়াত-৯৮।
গুনাহের মাঝে ডুবে থাকলেও বান্দা পরিত্রাণ পেতে পারে যা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ভাষ্যে পরিষ্কারভাবে বিধৃত আছে। একমাত্র খাস তওবা করে গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা এবং তার ওপর অবিচল থেকে ইবাদাত বন্দেগীতে ব্যস্ত থেকে জীবন কাটিয়ে দিয়ে তার দরবারে হাজিরা দিতে পারলেই মহামুক্তি লাভ ঘটবে অন্যথায় আখেরাতের জীবনটা অর্থহীন হবে আর জাহান্নামের আগুনে ঝলসাতে হবে।
ইবাদাত বন্দেগীসহ সর্বদা তওবা ইস্তেগফারে মশগুল হতে হবে। হজরত শেখ সাদী রহ. বলেছেন- “আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার দরজা থেকে লাঞ্ছিত বঞ্জিত করে ফিরিয়ে দিও না, কেননা আমিতো তোমার দরজা ভিন্ন আর কারো দরজায় যাবো না।”